নীহারিকা আর রূপা, দুই বোন। ছোটবেলা থেকেই ওরা একে অপরের ছায়াসঙ্গী। তাদের মা ছোটবেলাতেই চলে গেছেন। বাবার কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বড় হলেও দুই বোনের সম্পর্ক ছিল গভীর মমতায় মোড়া। তাদের জীবনের গল্প ছিল এক সহজ অথচ গভীর বন্ধনের গল্প।
নীহারিকা ছিল বড় বোন। বয়সে পাঁচ বছরের বড় হলেও সে ছিল রূপার চোখে মা, বন্ধু আর অভিভাবক—সবকিছু। জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করে পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিল সে। রূপা ছিল স্বপ্নবিলাসী, ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে। দিদির কড়া শাসনের মধ্যেও সে সবসময় নিজের মতো স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসত। তাদের সংসার ছিল ছোট, কিন্তু একে অপরের সঙ্গের জন্য পূর্ণ।
তবে সময় কখনো থেমে থাকে না। বাবার মৃত্যুর পর সেই ছোট সংসারের ভার পুরোপুরি নীহারিকার ওপর এসে পড়ল। বাবার মৃত্যুর খবরটি এক সন্ধ্যায় তাদের কাছে পৌঁছেছিল। সেই সন্ধ্যায় রূপা প্রথমবার তার দিদির চোখে অশ্রু দেখেছিল। তার দিদি, যে সবসময় সাহস আর দায়িত্বের প্রতীক ছিল, হঠাৎ যেন ভেঙে পড়েছিল। রূপা সেদিন বুঝেছিল, তার স্বপ্নের আড়ালে দিদির কাঁধে কত বড় দায়িত্বের বোঝা।
বাবার মৃত্যুর পর নীহারিকা আরও বেশি শক্ত হয়ে উঠল। সে একটি ছোট চাকরি পেয়ে সংসার চালানোর দায়িত্ব নিল। কিন্তু তার নিজের জীবন যেন থেমে গেল। তার পড়াশোনা, তার নিজের ছোটখাটো ইচ্ছেগুলো—সবকিছু ছাপিয়ে উঠে এল শুধু একটাই লক্ষ্য, রূপার ভবিষ্যৎ।
রূপার কলেজে ভর্তি হওয়া ছিল তাদের জীবনের বড় এক ঘটনা। রূপা ছিল চঞ্চল আর আনন্দমুখর। সে কলেজে নতুন বন্ধু, নতুন স্বপ্ন আর নতুন জীবনের খোঁজ পেল। কিন্তু প্রতিদিন সে যখন বাড়ি ফিরত, তার চোখে ভেসে উঠত দিদির ক্লান্ত মুখ। নীহারিকা দিনে চাকরি করত আর রাতে টিউশনি। রূপা তাকে অনেকবার বলেছিল, “দিদি, আমি পারব না। এত খরচ তুমি কেন করছ?”
কিন্তু নীহারিকা সবসময় বলত, “তুই পারবি রে। আমার চেয়ে তুই অনেক বড় হবি। এই ছোট চাকরিতে আমার জীবন যাবে, কিন্তু তোর জীবন যেন আলাদা হয়।”
এরপর সময় এগিয়ে চলল। এক সন্ধ্যায় নীহারিকা জানালার পাশে বসে দূরে তাকিয়ে ছিল। রূপা সেদিন খুব খুশি। সে তার কলেজের একটি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সে যখন বাড়ি ফিরল, দিদির বিষণ্ণ মুখ দেখে তার আনন্দ যেন মিলিয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে দিদির পাশে গিয়ে বসল।
“দিদি, তুমি কেন এত চাপা?”
নীহারিকা প্রথমে কোনো কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমার ভবিষ্যতের কথা ভাবছি রে রূপা। আমি তো আর সবসময় থাকতে পারব না। তোমার স্বপ্নগুলো যেন কখনও ভেঙে না যায়।”
রূপা তার দিদির হাতে হাত রেখে বলল, “তুমি না থাকলে আমি কী করে থাকব দিদি? তোমার সাহসই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
নীহারিকা চুপ করে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, রূপা এখনও অনেক ছোট। সে জানে না এই সংসারের কত রকম চাপ। কিন্তু রূপার এই সরল কথা তার মনে এক আশার আলো জাগাল।
পরের দিন থেকে রূপা তার দিদির সঙ্গে সংসারের কাজে হাত লাগাতে শুরু করল। সে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি নিতে শুরু করল। নীহারিকা প্রথমে আপত্তি করেছিল। “তুই কেন এসব করবি? পড়াশোনায় মন দে।”
কিন্তু রূপা বলল, “তোমার মতো আমিও যদি না লড়াই করি, তবে তুমি একা পারবে না দিদি। সংসার আমাদের দু’জনের।”
এইভাবে দিনগুলো চলতে থাকল। সময়ের সাথে সাথে রূপা তার পড়াশোনা শেষ করল। সে একটি ভালো চাকরি পেল। নীহারিকার মুখে প্রথমবার শান্তির ছাপ দেখা গেল। কিন্তু সুখ যেন কখনও স্থায়ী হয় না।
একদিন রূপার অফিস থেকে ফোন এলো। সে একটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। সেই দিন নীহারিকা আবার একবার ভেঙে পড়ল। কিন্তু এইবার সে তার কান্নাকে চেপে রেখে রূপার পাশে দাঁড়াল।
হাসপাতালের দিনগুলো তাদের জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু করল। রূপা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। সে হাসতে শুরু করল, কিন্তু নীহারিকা যেন আর আগের মতো রইল না। তার শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিল।
রূপা একদিন বলল, “দিদি, এবার তোমার বিশ্রামের সময় এসেছে। আমি এখন বড় হয়েছি। সংসারের দায়িত্ব এখন থেকে আমার।”
নীহারিকা হাসল। সে বলল, “তুই বড় হবি রূপা। আমি শুধু দেখতে চাই, তুই স্বপ্নপূরণ করছিস। এটাই আমার বিশ্রাম।”
একদিন সূর্যাস্তের সময় দুই বোন জানালার পাশে বসে ছিল। রূপা নীহারিকার কাঁধে মাথা রেখে বলল, “তোমার মতো মানুষ পৃথিবীতে হয় না দিদি। তুমি আমার মা, বন্ধু, সবকিছু।”
নীহারিকা বলল, “তুই-ও আমার সবকিছু রে। তোর জন্যই আমি আজ পর্যন্ত বেঁচে আছি।”
বাইরে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। জানালার কাঁচে শেষ আলো তাদের দুই বোনের স্নেহের বন্ধনকে জড়িয়ে ধরছিল।