রক্তিম সিঁদুরে রাঙানো মুখ, মুখভর্তি দৃঢ়তার ছাপ, চোখে অদ্ভুত তেজ। এই মুখের মাঝে যেন মিশে আছে মা দুর্গার রূপ। এ মুখের অধিকারিণী হল মানসী—গ্রামের এক সাহসী মেয়ে, যার মনের অদম্য জেদ ও লড়াইয়ের স্পৃহা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। সে জানে, তার জীবনটা সহজ হবে না। সমাজের চোখে নারী এখনও দুর্বল, তবে মানসী মনে করে, তার মতো নারীরা সমাজের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
ছোটবেলা থেকেই মানসী ছিল প্রতিবাদী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তার কখনোই দ্বিধা হয়নি। পাড়ার অনেকেই তার এই স্বভাবটা নিয়ে কথা বলত। তাকে নিয়ে নানা গুঞ্জন, কটূক্তি করত। গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েরাই যখন ভদ্রতার মোড়কে নিজের স্বাধীনতাকে আটকে রাখে, তখন মানসী নিজের পছন্দ, নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে খোলাখুলি কথা বলত। তার সোজাসাপ্টা কথাবার্তা এবং চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করার এই গুণ তাকে আলাদা করেছিল। অনেকেই তাকে ‘বেয়াড়া’ বলে অভিহিত করত, কিন্তু সে কখনোই কারো কথা কানে নেয়নি। মানসী জানত, মেয়েদের এই বাঁচার রীতিনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়।
গ্রামের মেয়েরা সাধারণত নিজেকে গুটিয়ে রাখে, স্বামী-সংসারের দায়িত্বে জীবন কাটায়। কিন্তু মানসী চেয়েছিল এই শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে। সে মনে করত, নারী হওয়া দুর্বলতার পরিচয় নয়। বরং নারীরাই শক্তির প্রতীক। গ্রামের মন্দিরের প্রতিমা মা দুর্গা যেন তার সেই বিশ্বাসেরই প্রেরণা। প্রতি বছর শারদীয়া পূজার সময় মানসী মন্দিরে গিয়ে মা দুর্গার সামনে প্রণাম জানায়, যেন তার জীবনের প্রতিটি বাঁধাকে হারানোর সাহস মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে যায়।
এবারের বিজয়া দশমীও তার ব্যতিক্রম নয়। মন্দিরে মা দুর্গার বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠেছে। মেয়েরা সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে, সবাই পরস্পরকে সিঁদুর পরিয়ে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মানসী সেদিন মন্দিরে এসে মাকে শেষ প্রণাম জানিয়ে মনে মনে এক প্রতিজ্ঞা করল। সে অনুভব করল, এই প্রতিমার মায়ের বিদায়ের সাথে যেন তার জীবনেরও এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। আজ মা দুর্গার কাছ থেকে যেন এক নতুন শক্তি, এক নতুন সাহস সে পেয়ে গেল।
মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ল গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ পুরুষ তাকে নিয়ে আলোচনা করছে। “এই মেয়ে দিন দিন বেশি সাহসী হয়ে উঠছে, গ্রামের মেয়েরা যেমন থাকে, তেমন তো আর থাকছে না। এভাবে চলতে থাকলে তো সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।”
মানসী সোজা তাকিয়ে তাদের দিকে বলল, “সমাজের নিয়ম মেনে চলার দায়িত্ব যদি শুধু মেয়েদের ওপর থাকে, তাহলে এ সমাজে কখনোই পরিবর্তন আসবে না। আমি এই সমাজের জন্য নয়, নিজের জন্য বাঁচতে চাই।”
তার কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা জানত না, মানসীর এই সাহসিকতা তার আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মানসী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখল। সিঁদুরে লাল তার মুখ, চোখে জ্বলে ওঠা এক অদ্ভুত আগুন। সে মনে মনে বলল, “মা, তোমার মতো আমিও লড়াই করব। তোমার মতো আমিও সব বাঁধাকে হারিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব।”
রাতে বাবা তাকে বললেন, “মানসী, তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। তোকে এবার সংসারী হতে হবে। মেয়েদের জীবনে এক সময় তো সংসারী হতেই হয়।”
মানসী নির্ভয়ে বলল, “বাবা, আমার জীবন নিয়ে আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চাই। বিয়ে যদি করতে হয়, তবে তা আমার শর্তেই হবে। আমি কারো অধীনস্থ হয়ে জীবন কাটাতে পারব না।”
বাবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি জানতেন, তার মেয়ে বরাবরই সাহসী, কিন্তু এমন স্পষ্টভাবে নিজের কথা জানাবে, সেটা তিনি আশা করেননি।
এরপরের দিনগুলোতে মানসী গ্রামের মেয়েদের কাছে এক উদাহরণ হয়ে উঠল। অনেক মেয়ে তার কাছে এসে তাদের মনের কথা জানাত, তাদের সীমাবদ্ধতাগুলো তাকে বলত। মানসী তাদের সাহস দিত, বলত, “তোমরা নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলো। কোনো কিছুই সমাজ তোমাদের দেবে না, নিজেরাই নিজের পথ গড়ে নিতে হবে।”
কিছুদিন পর মানসী একটি চাকরির জন্য শহরে গেল। সেখানে তার পরিচয় হয় অরিন্দম নামে এক যুবকের সাথে। অরিন্দম একজন সমাজকর্মী, যে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাধীনতার বিষয়ে কাজ করছে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। মানসী তাকে তার জীবনের গল্প শোনাল। অরিন্দম তাকে বলল, “তুমি যা করছ, সেটা অনেক মেয়ের জন্যই অনুপ্রেরণা। তবে আরও অনেক কিছু করার আছে।”
অরিন্দমের এই কথাগুলো মানসীর মনে গভীর ছাপ ফেলল। সে বুঝল, শুধু নিজের অধিকার নিয়েই নয়, অন্যদের জন্যও কিছু করা প্রয়োজন।
গ্রামে ফিরে আসার পর সে মেয়েদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করল। গ্রামের মেয়েরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার নিয়ে সচেতন হতে শুরু করল। যারা আগে মানসীকে ‘বেয়াড়া মেয়ে’ বলে দিত, তারাই এখন তার প্রশংসা করতে লাগল। মানসী আজ তার গ্রামের মেয়েদের কাছে এক ‘দুর্গা’রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বছর ঘুরে আবার দুর্গাপূজার সময় এল। এবার বিজয়া দশমীতে মন্দিরে মা দুর্গার সামনে দাঁড়িয়ে মানসী মনে মনে বলল, “মা, তোমার কাছ থেকে পাওয়া শক্তি আমি আজ আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। আজ আমি গর্বিত, কারণ আমি আমার নিজের জন্য, আমার আত্মসম্মানের জন্য লড়তে পেরেছি।”
সেদিন মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময় সিঁদুরে মাখানো মুখে এক অপার্থিব তেজ ছিল। তার দৃঢ় চোখে প্রতিজ্ঞার আগুন জ্বলছিল। নিজের আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতায় আজ মানসী সমাজের কাছে এক নতুন বার্তা দিয়েছে—নারীর শক্তি, সাহস ও মর্যাদা কোনোদিনও ছোট নয়।