সন্ধ্যার রোদ্দুর যখন পশ্চিম দিগন্তে লুকিয়ে পড়ছে, তখন গ্রামের মাঠে মেঠো পথের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল কুমু। তার কোঁকড়া চুলের মেঘ যেন সেই রোদ্দুরকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। চোখে ছিল এক অদ্ভুত উদাসীনতা, আর ললাটে লাল সিঁদুর যেন তার জীবনচিত্রকে আরো গভীর করে তুলেছিল। কুমু, যার নাম শুনলে গ্রামবাসীর মনের কোণে একটা প্রশান্তি খেলে যায়, সে আজ যেন কোন এক অজানা দুঃখে নিমজ্জিত।
কুমুর বয়স ছিল মাত্র তেইশ। গ্রামের মেয়েদের মধ্যে তার সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। সবাই বলত, “কুমু যেন কোন দেবীর মূর্তি।” কিন্তু তার সেই মায়াবী মুখশ্রীতে আজকাল একরকম চাপা কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। বিয়ের পরে তার জীবনটা যেন রূপকথার মতো হবে, এমন আশা করেছিল সে। কিন্তু তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তার স্বামী হরেন ছিল এক শহুরে মানুষ, যার মন পড়ে থাকত তার কাজের মধ্যে।
কিন্তু আজকের দিনটা ছিল অন্যরকম। কুমু একটা চিঠি পেয়েছিল। সেই চিঠি ছিল তার পুরনো দিনের বন্ধু অরুণের কাছ থেকে। অরুণ ছিল তার শৈশবের সঙ্গী, যার সঙ্গে সে খেলাধুলো করেছে, জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছে। অরুণ তার শহরে চলে গিয়েছিল পড়াশোনা করার জন্য। কুমু ভাবত, তাদের বন্ধুত্বের গল্পটা হয়তো সেখানেই শেষ। কিন্তু আজকের সেই চিঠি যেন তার পুরনো স্মৃতিকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল।
চিঠিতে অরুণ লিখেছিল, “কুমু, আমি জানি তুমি অনেক সুখী। তবু তোমার কথা ভাবলে আমার মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। আমি তোমার জীবনে আর কোনো ঝামেলা আনতে চাই না। কিন্তু আমার একটা শেষ ইচ্ছা আছে। আমি তোমাকে শেষবার দেখতে চাই।”
চিঠি পড়ে কুমুর চোখে জল চলে আসে। সে জানত, এই দেখা তার বর্তমান জীবনে কোনো ভালো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু তার মনের গভীরে কোথাও একটা অদম্য আকাঙ্ক্ষা ছিল অরুণের সঙ্গে দেখা করার।
পরের দিন সকালে, গ্রামের বাইরে ছোট্ট নদীর ধারে কুমু আর অরুণের দেখা হয়। অরুণ ছিল কুমুর মতোই অল্প বয়সে পরিণত। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
“কেমন আছিস কুমু?” অরুণ জিজ্ঞেস করল।
কুমু কিছু বলল না। তার চোখে চোখ রেখেই উত্তর দিল।
“তুই তো অনেক দূরে চলে গেছিস। আমার জীবনটা তুই বুঝবি না,” কুমু অবশেষে বলে উঠল।
অরুণ হেসে বলল, “আমি তোর জীবনের সবটুকু বুঝি না। কিন্তু তোর চোখের ভাষা পড়তে পারি।”
তারা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল। তাদের কথাগুলোর মধ্যে ছিল পুরনো দিনের স্মৃতি, বর্তমান জীবনের কঠিন বাস্তবতা, আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
কুমুর মনে হলো, অরুণ তার সেই ছায়া, যে তাকে সবসময় আগলে রাখবে। কিন্তু সেই ছায়া ছুঁতে পারার অধিকার তার নেই।
শেষবার যখন তারা বিদায় নিচ্ছিল, অরুণ বলল, “কুমু, তুই সবসময় সুখী থাকিস। তোর হাসি যেন কোনদিন হারিয়ে না যায়।”
কুমু হেসে বলল, “সুখী থাকা কি এত সহজ অরুণ? তবু আমি চেষ্টা করব। তুইও ভালো থাকিস।”
তারা দুজনেই জানত, এই দেখা ছিল তাদের শেষ দেখা। কুমু ফিরে গেল তার বাস্তব জীবনে, আর অরুণ ফিরে গেল শহরে। কিন্তু তাদের সেই মুহূর্তগুলো রয়ে গেল স্মৃতির পটে।
কুমু জানত, তার জীবনে ভালোবাসা শব্দটা হয়তো কখনো পূর্ণতা পাবে না। কিন্তু সেই নির্বাক ভালোবাসা তাকে একটা অনুপ্রেরণা দিত, জীবনকে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
আর সেই নদীর ধারে বাতাসে মিশে রইল এক নির্বাক গল্পের সুর।