শুভ বিজয়ার সকাল। চারপাশে যেন এক বিষণ্ণ আনন্দের আবহ। প্রতিমা বিসর্জনের আগে মন্দির চত্বরে সকলে মিলে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে। রঙিন আবেশে ডুবে গেছে পুরো পরিবেশ, চারদিকে উড়ছে লাল সিঁদুরের গুঁড়ো। মেয়েরা একে অপরের গালে সিঁদুর মাখিয়ে হাসছে, যেন এই শেষ দিনটুকুর জন্যেই তারা অপেক্ষা করেছিল। আকাশ যেন এই লাল সিঁদুরে রঙিন হয়ে উঠেছে, সূর্যের আলো সিঁদুরের গুঁড়োয় প্রতিফলিত হয়ে এক অপার্থিব আভা সৃষ্টি করছে।
মন্দিরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কল্পনা। সাদা শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা লাল সিঁদুরের দাগ তার মনের কথা প্রকাশ করে দিচ্ছে। মুখে প্রশান্তির ছাপ, আর তার গভীর চোখে যেন হাজার রকমের অনুভূতির ঝলক। মায়ের বিদায়ের এই ক্ষণে তার বুকের ভেতর মিশে আছে বিদায়ের বিষণ্ণতা আর পরের বছরের প্রত্যাশা। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, মনের মধ্যে একটা গভীর শূন্যতা। একবারে যেন সমস্ত স্মৃতিগুলো তার মনে পড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে এই পুজোর দিনগুলো কল্পনার কাছে বিশেষ কিছু। প্রতি বছর মা দুর্গার আগমনের সাথে সাথে তার মনটাও যেন উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।
কল্পনার জীবনের এই পুজোটা ছোটবেলা থেকেই বিশেষ। মায়ের পায়ের তলায় বসে প্রতিদিন প্রার্থনা করত সে। সে সবসময়ই মাকে মনে মনে সব দুঃখ, সব কষ্ট জানিয়ে দিত। এই ক’টা দিনই যেন তার মনের কথা শোনার জন্য একজন আছে। আর যেন নতুন আশায় ভরপুর হয়ে বাড়ি ফেরে। তার বিশ্বাস, মা দুর্গা তার সব কথা শুনে নিয়েছেন এবং তাকে আশীর্বাদ করছেন। তবে আজ তার চোখের কোল ভিজে উঠছে মায়ের বিদায়ের বেদনায়। মনে হচ্ছে, যেন নিজের খুব কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলছে সে।
কিন্তু সেই অশ্রুর মাঝেও রয়েছে এক আনন্দের অনুভূতি—একটা বারের জন্য সিঁদুরে রাঙানো মুখ, চারপাশের মানুষের হাসি, মায়ের সান্নিধ্য। যেন এই মুহূর্তগুলোয় সে নিজেকে পূর্ণ পায়। এটাই তো তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। এই আনন্দময় পরিবেশে সবার সাথে মিশে গিয়ে, একটু খুশি হওয়ার সময়। এই সময়টুকুতে সে নিজেকে একা নয়, বরং হাজারো মানুষের সাথে একাত্ম মনে করে।
কল্পনা অনুভব করে, এই কয়েকদিন মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোতেই তার জীবনের মানে খুঁজে পায় সে। প্রতিমার পায়ের কাছে বসে সে নিজের সমস্ত স্বপ্ন, আশা-নিরাশা মাকে জানিয়ে আসে। মা দুর্গার সামনে বসে, তার নিজের দুর্বলতাগুলোকে ছেড়ে আসার এক অসীম শক্তি অনুভব করে কল্পনা। মায়ের বিদায়ের এই দিনে তার মনেও যেন এক অদ্ভুত সাহস এসে বসে। যেন মনে হয়, সে আবার নতুন করে শুরু করতে পারবে।
বিদায়ের আগে একবার শেষবারের মতো কল্পনা মূর্তির দিকে তাকায়। নিজের সিঁদুরমাখা হাতটা জোড় করে মাকে প্রণাম জানায়, মনে মনে বলে, “মা, পরের বছর আবার দেখা হবে।” তার মনে হয়, মা তার এই কথাটা শুনেছেন, তার আশীর্বাদে ভরে উঠেছে কল্পনার মন। বিদায়ের বেদনা থাকলেও, তার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। মা দুর্গা তাকে আবারও নতুন করে পথ চলার জন্য শক্তি দিয়েছেন।
কল্পনা মনে মনে ভাবতে থাকে, আগামী বছর আবারও এই দিনগুলো ফিরে আসবে। আবার সে মায়ের সামনে নিজের দুঃখ-কষ্ট উজাড় করে দিতে পারবে। মায়ের প্রতিমা মূর্তির দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে শপথ নেয়, যে কোনো প্রতিকূলতা থাকুক না কেন, সে নিজেকে শক্ত রেখেই লড়াই চালিয়ে যাবে।
মন্দির প্রাঙ্গণে সবাই মিলে প্রতিমা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নদীর দিকে। কল্পনাও সেই মিছিলের অংশ হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। সবার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ, তবুও এক অদ্ভুত সম্মিলিত উচ্ছ্বাস। নদীর তীরে এসে প্রতিমা বিসর্জনের মুহূর্তটি যেন সবার মনকে আরও ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। সবাই একসঙ্গে মাকে বিদায় জানাচ্ছে, চোখের কোণ ভিজে উঠছে অনেকেরই। কল্পনার বুকের মধ্যে যেন সেই বিদায়ের ভার অনুভূত হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে, কিন্তু সে এটাকে আবেগের দুর্বলতা হিসেবে নয়, বরং ভক্তির পরিপূর্ণতা হিসেবে অনুভব করছে।
মা দুর্গার প্রতিমাটি ধীরে ধীরে নদীর জলে মিলিয়ে যাচ্ছে, আর কল্পনার মনে হচ্ছে, তার সব স্মৃতি, সব আবেগ, সমস্ত ভালোবাসা এই নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে। সে অনুভব করছে, এই বিদায়ের সাথে সাথে সে নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। তবে এই শূন্যতায় আছে আশা, আছে অপেক্ষা। পরের বছর মা দুর্গা আবার ফিরে আসবেন, আবার তার জীবনে এই পূর্ণতার মুহূর্ত ফিরে আসবে।
যখন সবাই ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করল, তখন কল্পনা একবার নদীর দিকে ফিরে তাকাল। তার মনের মধ্যে যেন এক শক্তি ফিরে এলো। মনে হল, মা দুর্গা তাকে আশীর্বাদ করে গেছে। পরের বছর পর্যন্ত সে এই আশীর্বাদ নিয়েই বাঁচবে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় তার মন যে খালি হয়ে গিয়েছিল, সেই খালি মনেই যেন মায়ের আশীর্বাদের স্পর্শ তাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
ধীরে ধীরে বাড়ি ফেরার পথে কল্পনা মনে মনে বলে উঠল, “মা, তোমার আশীর্বাদ যেন আমার সঙ্গে সবসময় থাকে। আগামী বছর আমি আবার আসব, তোমার সান্নিধ্যে নিজেকে খুঁজে পাব।” তার এই অনুভূতিগুলো যেন প্রতিটি পা ফেলায় প্রতিফলিত হচ্ছিল, তার মুখে এক প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠল।
মায়ের বিদায়ের এই দিনে কল্পনা বুঝতে পারল, প্রতিটি বিদায়ে আসলে নতুন সূচনার বীজ রোপিত হয়। আর সেই বীজ থেকেই সে পরবর্তী বছরের জন্য শক্তি, সাহস আর অনুপ্রেরণা খুঁজে নেয়।