রাতে ঝিরঝিরে বাতাস বইছে, আর আকাশ ভরা অজস্র তারা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারের মাঝে একটিমাত্র কুপি-লন্ঠনের ক্ষীণ আলো। এই গ্রামে এখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি, তাই প্রতিটি বাড়িতে সন্ধ্যা নামলেই কুপি-লন্ঠন জ্বলে ওঠে। সন্ধ্যার পরপরই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু রানু আজ জেগে আছে। হাতে একটি কুপি-লন্ঠন ধরে সে তাদের ছোট্ট ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ রাস্তার দিকে নিবদ্ধ। তার প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাইছে না।
রানুর স্বামী, অমল, তিন মাস আগে কাজের খোঁজে শহরে গিয়েছিল। এই দীর্ঘ সময় ধরে সে পথ চেয়ে আছে, কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যার প্রহর কাটলেও অমলকে ফেরার পথে দেখে না। রানু জানে, অমলের শহরে যাওয়ার কারণ ছিল মন্দা, গ্রামের চাষাবাদে তখন চরম দুর্দশা নেমে এসেছিল। সংসারে অভাব তাড়াতে বাধ্য হয়ে অমল তাকে ছেড়ে শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তার মনের ভেতর সবসময় অমলের সেই শেষ দিনের কথাগুলো ঘুরপাক খায়—“রানু, চিন্তা করিস না। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। তোদের একা কষ্ট পেতে দেব না।”
কিন্তু সময় তো আর মানুষের কথা শোনে না। তিন মাসের বিরহে প্রতীক্ষার প্রতিটি প্রহর রানুর জন্য দিন দিন দীর্ঘতর হয়ে উঠছে। প্রতিদিন সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কেবল নীরব পথ আর নিস্তব্ধ রাতের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই তার সামনে আসে না। প্রতিদিনের মতো আজও সে অপেক্ষা করছে, তবে আজ যেন তার মনে এক অজানা আশা জন্ম নিয়েছে। মনে হচ্ছে, আজ হয়তো তার অমল ফিরবে। হালকা বাতাসে লন্ঠনের আলো দুলছে, আর সেই আলোয় রানুর মুখে এক অপার্থিব আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তার চোখে রয়েছে অপেক্ষার নীরব যন্ত্রণা আর অমলকে ফিরে পাওয়ার গভীর আকাঙ্ক্ষা।
রাত আরও গভীর হয়, এবং ঠাণ্ডা হাওয়ায় রানুর শাড়ির আঁচল হালকা দুলছে। সে মনে মনে অমলের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করার চেষ্টা করছে। কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো, যখন তারা একসাথে খেতে বসত, মাঠে কাজ করত, এবং রাতের বেলা আকাশের তারার নিচে বসে গল্প করত। মনে পড়ে, একদিন তারা নদীর তীরে বসে ছিল, আর অমল তাকে বলেছিল, “তুই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি রানু।” সেই কথাগুলো তার মনে এখনও তাজা হয়ে আছে, আর আজও সেই কথাগুলোই তাকে শক্তি যোগাচ্ছে, অপেক্ষার প্রহরগুলো পার করতে সাহায্য করছে।
একসময় দূরে কুয়াশাচ্ছন্ন পথে কিছু শব্দ শোনা গেল। রানুর হৃদয় ধুকপুক করে উঠল। হঠাৎ দূরে একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, “রানু!” সেই কণ্ঠস্বর যেন রাতের সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিল। তার হৃদয়জুড়ে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। সে বুঝল, তার প্রিয় মানুষটা ফিরে এসেছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ সেই দিন এসেছে, যখন তার চোখের সামনে তার প্রিয়জনকে দেখতে পাবে।
লন্ঠনের আলো হাতে সে দ্রুত পথে এগিয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অমল, ক্লান্ত, মলিন, কিন্তু চোখে তার সেই পুরনো মায়ার ছাপ। অমল ধীরে ধীরে এগিয়ে এল রানুর দিকে, আর রানু তাকিয়ে রইল তার চোখে। দুজনের চোখের ভাষাই যেন সব কথা বলে দিচ্ছে। এই তিন মাসের সমস্ত কষ্ট, সমস্ত দুঃখ, সমস্ত অপেক্ষা যেন মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রানু চোখ ভিজে উঠল, তবে সে অমলের সামনে নিজেকে শক্ত রাখতে চাইল।
অমল রানুর দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসল, “আমি তো তোকে কথা দিয়েছিলাম, রানু। তুই চিন্তা করিস না, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”
রানু চোখ মুছে হাসল, “তুই যদি না ফিরতিস, আমি কী করে বাঁচতাম বল?”
অমল একটু হাসল, “জানি, রানু। তোকে ছাড়া আমারও কিছু হয় না। তুই তো আমার সবকিছু।”
রানু অমলের হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে এল, তাদের ছোট্ট বাড়ির সেই পরিচিত পরিবেশে। তার অপেক্ষার রাত আজ সার্থক হলো।